রক্তের অ্যালার্জি শব্দটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট রোগ হিসেবে
ব্যবহৃত না হলেও, সাধারণভাবে এটি এমন এক অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যখন শরীরের
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা রক্তের উপাদান বা রক্তের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা কোনো
পদার্থের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই অ্যালার্জির ফলে শরীরে
চুলকানি, ফুসকুড়ি, জ্বর, দুর্বলতা, বা ত্বকের পরিবর্তনসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে
পারে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক রক্তের অ্যালার্জির কারণ, লক্ষণ এবং এটি প্রতিরোধ ও
নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায়গুলো সম্পর্কে।
রক্তের অ্যালার্জির কারণ
রক্তের অ্যালার্জি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো
হলো ঃ
রক্ত সঞ্চালনের প্রতিক্রিয়া
রক্ত সঞ্চালনের প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে শরীরে রক্তের প্রতি এলার্জি
প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এক দেহ থেকে অন্য দেহে রক্ত প্রবেশ করানোর
ফলে কখনো কখনো রোগীর ইমিউন সিস্টেম নতুন রক্তকণিকাকে বিদেশি উপাদান হিসেবে
চিহ্নিত করে এবং প্রতিরোধক ক্রিয়া শুরু করে।
এর ফলে জ্বর, চুলকানি, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট বা হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়ার
মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের আগে রক্ত সঞ্চালন হয়েছে বা যাদের
অ্যালার্জির ইতিহাস আছে, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
যথাযথ রক্ত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ এসব জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
ওষুধজনিত অ্যালার্জি
ওষুধজনিত অ্যালার্জি হলো এমন এক প্রতিক্রিয়া যেখানে শরীর কোনো নির্দিষ্ট ওষুধকে
ক্ষতিকর মনে করে এবং এর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক, এবং কিছু ভ্যাকসিন বা ইনজেকশনে এই ধরনের
অ্যালার্জি বেশি দেখা যায়। উপসর্গ হিসেবে ত্বকে লালচে দাগ, চুলকানি, ফোলা,
শ্বাসকষ্ট, বমি বা গুরুতর ক্ষেত্রে অ্যানাফাইল্যাক্সিস দেখা দিতে পারে।
যার পূর্বে অ্যালার্জির ইতিহাস আছে বা একই ধরনের ওষুধ আগে ব্যবহার করেছে, তাদের
ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। সঠিক ওষুধ নির্বাচন, ডোজ নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের
পরামর্শ মেনে চললে এই অ্যালার্জির ঝুঁকি কমানো যায়।
খাদ্য ও পরিবেশগত উপাদান
খাদ্য ও পরিবেশগত উপাদান অনেক সময় শরীরে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে
পারে। নির্দিষ্ট খাবার যেমন বাদাম, দুধ, ডিম বা সামুদ্রিক খাদ্য ইমিউন সিস্টেমে
অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে চুলকানি, ফুসকুড়ি, বমি বা শ্বাসকষ্টের মতো
উপসর্গ ঘটাতে পারে। একইভাবে পরিবেশে থাকা ধূলিকণা, পরাগরেণু, পোষা প্রাণীর লোম
বা ছত্রাকে স্পোর অ্যালার্জি উদ্রেক করতে সক্ষম।
এসব উপাদান শ্বাসনালী ও ত্বকে প্রদাহ তৈরি করে হাঁচি, কাশি, নাক বন্ধ হওয়া বা
চোখ জ্বালাপোড়া বাড়ায়। যাদের অ্যালার্জির পূর্ব ইতিহাস আছে, তাদের ঝুঁকি বেশি।
সঠিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যসংবেদনশীলতা জানা থাকলে অ্যালার্জি প্রতিরোধ সহজ
হয়।
অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া
কখনও কখনও শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেরই কিছু রক্তকণাকে আক্রমণ করে, যাকে
বলে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া। অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ায় শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজস্ব
কোষ ও টিস্যুকে শত্রু হিসেবে ভাবতে শুরু করে, ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই অতিসংবেদনশীল অবস্থা শরীরকে বাইরের উপাদানের প্রতিও অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া
দেখাতে প্রভাবিত করে, যা অ্যালার্জির প্রবণতা বাড়ায়। ইমিউন সিস্টেমের এই
বিভ্রান্তি প্রদাহ, ত্বকে জ্বালা, শ্বাসনালীর সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন
অ্যালার্জিক উপসর্গের কারণ হতে পারে।
যাদের অটোইমিউন রোগ রয়েছে, তাদের ইমিউন প্রতিক্রিয়া সাধারণত অস্থিতিশীল থাকে,
ফলে অ্যালার্জি উদ্ভব বা তীব্রতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি। যথাযথ চিকিৎসা ও ইমিউন
নিয়ন্ত্রণ এসব জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
রক্তের অ্যালার্জির সাধারণ লক্ষণ
রক্তের অ্যালার্জি হলে যে উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে তা হলো:
-
ত্বকে লালচে দাগ, ফুসকুড়ি বা চুলকানি
-
মুখ, চোখ বা ঠোঁট ফুলে যাওয়া
-
শ্বাসকষ্ট বা বুক ধড়ফড়
-
জ্বর ও দুর্বলতা
-
মাথা ঘোরা বা হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া
-
কিছু ক্ষেত্রে অ্যানাফাইল্যাক্সিস (Anaphylaxis) নামক প্রাণঘাতী অবস্থা
এই উপসর্গগুলোর কোনোটি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
রক্তের অ্যালার্জি দূর করার উপায়
রক্তের অ্যালার্জি সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা নির্ভর করে এর মূল কারণের ওপর।
তবে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা বা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
১. চিকিৎসা পরামর্শ ও পরীক্ষা করান
এলার্জি দূর করতে নিয়মিত চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন
উপাদানে অ্যালার্জি হচ্ছে তা নিশ্চিত না হলে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, যেমন
স্কিন টেস্ট বা রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন। এসব পরীক্ষা অ্যালার্জির উৎস শনাক্ত
করতে সাহায্য করে। সমস্যা চিহ্নিত হলে চিকিৎসক ওষুধ, অ্যালার্জি কমানোর
ইনজেকশন বা জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন।
ধুলাবালি এড়িয়ে চলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং খাবার বাছাই করে খাওয়া
অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। নিয়মিত চিকিৎসকের ফলো-আপ নিলে অ্যালার্জি
অনেকটাই কমে যায় এবং দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক থাকে।
২. অ্যালার্জির উৎস এড়িয়ে চলুন
অ্যালার্জি দূর করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর উৎস বা ট্রিগারগুলো
এড়িয়ে চলা। কোন খাবার, ধুলাবালি, ফুলের পরাগরেণু বা পোষা প্রাণীর লোমে
অ্যালার্জি হয় তা আগে চিহ্নিত করতে হবে। এরপর ওই উপাদানগুলো থেকে নিজেকে দূরে
রাখা জরুরি।
বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নিয়মিত ধুলো ঝাড়া, বিছানার চাদর ধোয়া এবং
ভিড়–ধুলাযুক্ত স্থান এড়িয়ে চললে অ্যালার্জি অনেকটাই কমে।যাদের খাবারে
অ্যালার্জি আছে, তারা সেই খাবার না খাওয়ার চেষ্টা করবেন। অ্যালার্জির উৎস
এড়িয়ে চললে শরীরের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং দৈনন্দিন জীবন আরও
স্বস্তিদায়ক হয়।
৩. অ্যান্টিহিস্টামিন ও স্টেরয়েড ব্যবহার
এলার্জি দূর করতে অ্যান্টিহিস্টামিন ও স্টেরয়েড অনেক সময় ব্যবহার করা হয়, তবে
এগুলো ব্যবহারে সতর্ক থাকা জরুরি। অ্যান্টিহিস্টামিন সাধারণত চুলকানি, হাঁচি
বা চোখ জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে, কিন্তু ঘুম ঘুম ভাব বা মাথা ঘোরা
সৃষ্টি করতে পারে। স্টেরয়েড দ্রুত প্রদাহ কমায়, তবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে
শরীরের ক্ষতি হতে পারে, যেমন রক্তচাপ বৃদ্ধি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে
যাওয়া।
তাই এই ওষুধগুলো কখনোই নিজের ইচ্ছায় ব্যবহার করা উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ
অনুযায়ী সঠিক ডোজ ও সময় মেনে চললে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণ নিরাপদ হয় এবং
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও কমে।
৪. ইমিউনোথেরাপি
এলার্জি দূর করতে ইমিউনোথেরাপি একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে
অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান খুব অল্প মাত্রায় শরীরে প্রদান করা হয় যাতে
ধীরে ধীরে শরীর ওই উপাদানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এর ফলে ইমিউন সিস্টেম
অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করে এবং অ্যালার্জির উপসর্গ কমে আসে।
সাধারণত ইনজেকশন বা জিহ্বার নিচে রাখার মতো বিশেষ ড্রপের মাধ্যমে এই চিকিৎসা
দেওয়া হয়। ইমিউনোথেরাপি দীর্ঘমেয়াদি হলেও স্থায়ী উপশম দেয়। তবে এটি অবশ্যই
চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অধীনে করা উচিত, কারণ সঠিক মাত্রা
বজায় রাখা রোগীর নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৫. রক্ত পরিশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
এলার্জি দূর করতে রক্ত পরিশোধন বা প্লাজমাফেরেসিস সাধারণত গুরুতর ও জটিল
ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি। এতে রোগীর রক্ত থেকে প্লাজমা
আলাদা করে তার পরিবর্তে পরিষ্কার প্লাজমা বা বিকল্প তরল দেওয়া হয়, যাতে রক্তে
থাকা ক্ষতিকর অ্যান্টিবডি বা প্রদাহ–উদ্রেককারী উপাদান কমে যায়।
এই পদ্ধতি সাধারণ অ্যালার্জির জন্য নয়; বরং যখন অন্যান্য চিকিৎসা ভালোভাবে
কাজ না করে বা রোগীর অবস্থা জটিল হয়, তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এটি বিবেচনা করেন।
চিকিৎসার সময় রোগীর শারীরিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সবকিছুই
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী করা উচিত।
প্রাকৃতিক উপায় ও জীবনধারা পরিবর্তন
-
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন, এতে শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যায়।
-
ভিটামিন C, ভিটামিন E, এবং ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার (যেমন ফল,
সবজি, বাদাম, মাছ) গ্রহণ করুন।
-
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন, কারণ এগুলো রক্তের ইমিউন প্রতিক্রিয়া
বাড়াতে পারে।
-
পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখুন, কারণ স্ট্রেস ইমিউন
সিস্টেমকে দুর্বল করে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
যদি নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
-
শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
-
অজ্ঞান হয়ে পড়া বা মাথা ঘুরলে
-
শরীরে দ্রুত ফুসকুড়ি ছড়িয়ে পড়লে
-
ইনজেকশন বা রক্ত নেওয়ার পর হঠাৎ জ্বর বা ফুসকুড়ি দেখা দিলে
এ ধরনের পরিস্থিতি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই দ্রুত
চিকিৎসা প্রয়োজন।
শেষ কথা
রক্তের অ্যালার্জি অনেক সময় ভয়ংকর মনে হলেও সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতার
মাধ্যমে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিজের শরীর
কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করা। নিয়মিত
স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং চিকিৎসকের
নির্দেশনা মেনে চললে রক্তের অ্যালার্জি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url