বিদেশে কিভাবে নিরাপদে অন লাইনে টাকা লেনদেন করা যায়।


আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন আধুনিক বিশ্বে এক অতি সাধারণ বিষয় হলেও, প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ও আইনি কাঠামোর কারণে বিষয়টি কিছুটা জটিল হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো বা বিদেশ থেকে টাকা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম, পদ্ধতি এবং খরচের বিষয় জড়িত থাকে।


 

এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করবো কীভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে এবং বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা লেনদেন করা যায়, কত খরচ পড়ে এবং কোন কোন মাধ্যম ব্যবহার করা নিরাপদ ও আইনসম্মত।

পেজ সূচিপত্র ঃ বিদেশে কিভাবে নিরাপদে অন লাইনে টাকা লেনদেন করা যায়


 বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর অনুমোদিত ক্ষেত্র সমূহ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর অনুমতি নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে দেয়া হয়ে থাকে।
  • বিদেশে শিক্ষার খরচ
  • চিকিৎসা ব্যয়
  • ভ্রমণের খরচ
  • পরিবারের সদস্যকে খরচ পাঠানো
  • সফটওয়্যার/আইটি সেবা আমদানি
  • অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বা সেবা
এই লেনদেনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যথাযথ কাগজপত্র এবং অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।

পাঠানোর মাধ্যমসমূহ

ক) ব্যাংক ট্রান্সফার (SWIFT)
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর সবচেয়ে প্রচলিত মাধ্যম হচ্ছে SWIFT ট্রান্সফার, যা মূলত ব্যাংক থেকে ব্যাংকে অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি।SWIFT ব্যাংক ট্রান্সফার হলো আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ লেনদেনের একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি, যা ব্যাংক থেকে ব্যাংকে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে প্রেরক ব্যাংক একটি SWIFT কোড ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বিদেশি ব্যাংকে অর্থ পাঠায়।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শিক্ষার খরচ বা চিকিৎসার খরচ পাঠাতে এই পদ্ধতি বৈধভাবে ব্যবহার করা হয়। লেনদেন সম্পন্ন হতে সাধারণত ১-৩ কর্মদিবস লাগে। এর মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা সহজে পাঠানো যায়। এক্ষেত্রে ট্রান্সফার ফি ও কারেন্সি রেট ভিন্ন হতে পারে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত একটি মাধ্যম।
প্রক্রিয়া ঃ
  • বৈদেশিক মুদ্রা (যেমন: USD, EUR) অনুমোদিত ব্যাংকে জমা দিন
  • প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (যেমন: ইনভয়েস, পাসপোর্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিঠি ইত্যাদি) জমা দিন।
  • ব্যাংক SWIFT কোডের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেবে।
খরচ ঃ
ট্রান্সফার ফি
বিদেশে টাকা পাঠানোর সময় ব্যাংক ট্রান্সফারের (SWIFT) মাধ্যমে পাঠাতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ট্রান্সফার ফি দিতে হয়, যা সাধারণত প্রতি লেনদেনে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। এই ফি ব্যাংকের ধরন, প্রেরণের পরিমাণ এবং গন্তব্য দেশের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। 

কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক অতিরিক্ত প্রসেসিং চার্জও নিতে পারে। তাই টাকা পাঠানোর আগে ফি ও শর্তাবলী সম্পর্কে জেনে নিন  যাতে অপ্রত্যাশিত খরচ এড়ানো যায়।
কারেন্সি কনভার্সন মার্জিন
বিদেশে টাকা পাঠানোর সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ খরচ হলো কারেন্সি কনভার্সন মার্জিন যা সাধারণত ১% থেকে ২% পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি ব্যাংক বা মানি ট্রান্সফার কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত একটি অতিরিক্ত চার্জ, যা মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেটের সঙ্গে ব্যাংকের রেটের পার্থক্য থেকে নেওয়া হয়।

অর্থাৎ, আপনি যে রেটে টাকা পাঠাচ্ছেন, সেটি বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা কম হয়। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় ট্রান্সফার ফি থেকেও বেশি খরচ হতে পারে।
অতিরিক্ত প্রসেসিং ফি
কিছু ব্যাংকে অতিরিক্ত প্রসেসিং ফি থাকতে পারে।বিদেশে টাকা পাঠানোর সময় কিছু ব্যাংক শুধুমাত্র ট্রান্সফার ফি বা কারেন্সি কনভার্সন মার্জিন ছাড়াও  অতিরিক্ত প্রসেসিং ফি ও ধার্য করে থাকে। এই ফি সাধারণত লেনদেন প্রক্রিয়াজাতকরণ, কাগজপত্র যাচাই, এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের খরচ হিসেবে নেওয়া হয়।

প্রসেসিং ফি নির্দিষ্ট ব্যাংক ও লেনদেনের ধরন অনুসারে ভিন্ন হতে পারে এবং এটি অনেক সময় গ্রাহকের অজান্তেই চূড়ান্ত পরিমাণের সঙ্গে যুক্ত হয়। তাই টাকা পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সব ধরনের ফি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়া জরুরি।
খ) মানি ট্রান্সফার অপারেটর
বিদেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে মানি ট্রান্সফার অপারেটর (MTO) যেমন Western Union, MoneyGram, ও Remitly একটি সহজ ও দ্রুত মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়। এই সার্ভিসগুলো ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে কাজ করে এবং অনেক সময় মাত্র কয়েক মিনিটেই টাকা প্রাপকের কাছে পৌঁছে যায়।

যদিও বাংলাদেশ থেকে সরাসরি টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, নির্দিষ্ট অনুমোদিত উদ্দেশ্য (যেমন শিক্ষার খরচ বা চিকিৎসা) ইত্যাদি খরচ পাঠানোর ক্ষেত্রে MTO ব্যবহার করা যায়। এসব সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে সাধারণত $৫–$২০ ফি লাগে এবং ট্রান্সফারের সীমা ও খরচ সার্ভিস ও দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে।

বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর বিষয়সমূহ 

পাঠানোর কারণ সমূহ
  • প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)
  • পরিবারকে সহায়তা
  • ব্যবসা সংক্রান্ত পেমেন্ট
  • ফ্রিল্যান্সিং ইনকাম
  • অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে আয় (যেমন Fiverr, Upwork)
গ্রহণের মাধ্যমসমূহ
ক) ব্যাংক একাউন্টে ডিরেক্ট ট্রান্সফার
বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর একটি নিরাপদ ও প্রচলিত পদ্ধতি হলো ব্যাংক একাউন্টে ডিরেক্ট ট্রান্সফার। এতে প্রেরক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রাপকের ব্যাংকের SWIFT কোড ব্যবহার করে সরাসরি অর্থ পাঠাতে পারেন। এই পদ্ধতিতে সাধারণত ১-৩ কর্মদিবস সময় লাগে এবং বড় অঙ্কের টাকা সহজে লেনদেন করা যায়। 

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেরককে $৫-$৩০ ফি দিতে হয়, তবে বাংলাদেশি ব্যাংক সাধারণত রিসিভিং ফি নেয় না। প্রাপ্ত অর্থ মার্কেট রেট অনুযায়ী টাকায় রূপান্তর হয় এবং সরকার নির্ধারিত রেমিট্যান্স ইনসেনটিভও দিয়ে থাকে।
খ)রেমিট্যান্স কোম্পানি (MTOs)
বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে মানি ট্রান্সফার অপারেটর (MTO) যেমন Western Union, MoneyGram, RIA, ও Remitly গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব সার্ভিস দ্রুত, সহজ ও নির্ভরযোগ্যভাবে টাকা পাঠানোর সুযোগ দেয়, বিশেষ করে যেসব প্রাপক ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহার করেন না বা গ্রামীণ এলাকায় অবস্থান করেন। 

প্রাপকরা টাকা সরাসরি নিকটস্থ এজেন্ট বা মোবাইল ওয়ালেট (যেমন বিকাশ , নগদ) এর মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারেন। MTO-র মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সে সরকার ২.৫% পর্যন্ত ইনসেনটিভ দেয়, যা এটি আরও লাভজনক করে তোলে। ফলে এটি প্রবাসী আয় পাঠানোর একটি কার্যকর মাধ্যম।

পদ্ধতিঃ

  • প্রেরক বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠান
  • গ্রহণকারী ন্যাশনাল আইডি বা পাসপোর্ট দিয়ে টাকা তুলতে পারেন
  • অথবা, ব্যাংকে বা মোবাইল ওয়ালেটে (Nagad, bKash) টাকা গ্রহণ করা যায়

খরচঃ

  • প্রেরককে $5-$20 পর্যন্ত ফি দিতে হয়
  • রেমিট্যান্সে বাংলাদেশ সরকার ২.৫% ইনসেনটিভ দেয় (২০২৫ পর্যন্ত কার্যকর)
গ) মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)
বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব সেবা প্রাপককে দ্রুত, সহজ এবং নিরাপদ উপায়ে ঘরে বসেই মোবাইলের মাধ্যমে টাকা গ্রহণের সুবিধা করে  দেয়। প্রবাসীরা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় মানি ট্রান্সফার অপারেটরের (যেমন: Remitly, WorldRemit)  এর  মাধ্যমে সরাসরি MFS-এ টাকা পাঠাতে পারেন।

এ পদ্ধতিতে টাকা পৌঁছাতে কয়েক মিনিট সময় লাগে এবং ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সরকারের পক্ষ থেকে ২.৫% রেমিট্যান্স ইনসেনটিভ পাওয়ার কারণে এটি আরও আকর্ষণীয় ও লাভজনক হয়ে উঠেছে।

সুবিধাঃ

  • দ্রুততম (মিনিটের মধ্যে)
  • বাড়তি কোনো চার্জ নেই
  • সরকারিভাবে ইনসেনটিভ পাওয়া যায়
অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং ও পেমেন্ট গেটওয়ে
Payoneer 
ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। Upwork, Fiverr, Freelancer ইত্যাদি থেকে আয় Payoneer অ্যাকাউন্টে আসে এবং সেখান থেকে বাংলাদেশি ব্যাংকে ট্রান্সফার করা যায়।অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং এবং পেমেন্ট গেটওয়ে বর্তমানে বৈদেশিক আয় দেশে আনার অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম।




ফাইভার, আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকমসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করে আয় করা অর্থ নিরাপদে গ্রহণের জন্য Payoneer ও Wise (TransferWise) এর মতো গেটওয়ে ব্যবহৃত হয়। Payoneer ব্যবহার করে উপার্জিত ডলার সহজেই বাংলাদেশি ব্যাংক একাউন্টে স্থানান্তর করা যায়।

এতে কারেন্সি কনভার্সন ফি সাধারণত ২% এর মতো হয়। ফ্রিল্যান্স ইনকাম বৈধভাবে বাংলাদেশে আনা সম্ভব এবং নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে এটি করমুক্ত। ফলে তরুণ সমাজের জন্য এটি একটি কার্যকর ও লাভজনক উপার্জনের পথ হতে পারে।

এ বিষয়ে সর্তকতা 

বিদেশে অনলাইনে টাকা পাঠানো এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। প্রথমত, নির্ভরযোগ্য এবং স্বীকৃত মানি ট্রান্সফার সার্ভিস ব্যবহার করা উচিত, যেমন: Western Union, PayPal, Wise বা ব্যাংকের নিজস্ব রেমিট্যান্স সেবা। কখনোই অজানা বা অবিশ্বস্ত ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করা উচিত নয়, কারণ এতে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্রেরকের নাম, ঠিকানা ও লেনদেনের তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করে নিতে হবে। এছাড়াও, লেনদেনের রসিদ বা রেফারেন্স নম্বর সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাকিং বা ফিশিং প্রতারণা এড়াতে ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন পাসওয়ার্ড বা ওটিপি (OTP), কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না।

সর্বোপরি, বড় অঙ্কের লেনদেনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের বৈদেশিক লেনদেন নীতিমালাও জানা ও মানা উচিত। নিরাপদ লেনদেনের জন্য সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সতর্কতা অপরিহার্য। 

উপসংহার 

বিদেশে অনলাইনে টাকা পাঠানো ও বিদেশ থেকে দেশে টাকা গ্রহণ বর্তমানে অনেক সহজ ও দ্রুত হলেও এতে সতর্কতা অপরিহার্য। নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিশ্বস্ত এবং অনুমোদিত মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। প্রতারণা, হ্যাকিং বা তথ্যচুরির ঝুঁকি এড়াতে ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা এবং লেনদেনের রেকর্ড সংরক্ষণ করা জরুরি। 

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং সচেতনতা থাকলে অনলাইন মানি ট্রান্সফার হতে পারে একদম ঝামেলামুক্ত ও নিরাপদ। তাই প্রত্যেক ব্যবহারকারীর উচিত লেনদেনের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা এবং সবসময় সতর্ক থাকা। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url