রাতে ঘুম না হলে কী করবেন: একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড
ভূমিকা
ঘুম আমাদের দেহ ও মনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। ভালো ঘুম না হলে দিনের কর্মক্ষমতা
কমে যায়, মন খিটখিটে থাকে এবং শরীর খারাপ অনুভব করে। তবে অল্প সময়ের জন্য ঘুম না
হলে কোনো সমস্যা হয় না।
কিন্তু যদি দীর্ঘ মেয়াদে ঘুম না হয় তাহলে ‘ইনসোমনিয়া’ বা অনিদ্রা হতে পারে।
সাধারণ কারণগুলি ঠিক করলে আপনি স্বাভাবিক ঘুমে ফিরে যেতে পারবেন। ঘুম আমাদের
মস্তিষ্ক ও শরীরের জন্য অপরিহার্য । নিয়মিত ঘুম আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণে,
মেটাবলিজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে বিভিন্ন কারণে যেমন উদ্বেগ, অনিয়মিত রুটিন, উপযুক্ত পরিবেশের
অনুপস্থিতি বা অতিরিক্ত কফি পান রাতে ঘুমের সমসৗা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের
ঘুমের ঘাটতি হালকা পর্যায়ে থাকলেও মন খিটখিটে, মনোযোগের অভাব ও শরীর ক্লান্ত
করে যা দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ও মেজাজজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
সূচিপত্র
১. ইনসোমনিয়া কী, এবং কেন হয়?
ইনসোমনিয়া হলো এক ধরণের ঘুমের সমস্যা, যেমনঃ ঘুম আসতে দেরি হওয়া কিংবা রাতে
বারবার ঘুম ভাঙা অথবা একেবারেই ঘুম না হওয়া। এটি স্বল্পমেয়াদি অথবা
দীর্ঘমেয়াদি (চিরস্থায়ী) হতে পারে ।এই সমস্যার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
মানসিক চাপ,ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, ক্যাফেইন/অ্যালকোহল/নিকোটিন গ্রহণ,
অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচি, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের আলো, খারাপ খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি
।
২. ঘুম ভালো করার উপায়
(ক) ঘুমের হাইজিন বা নিয়মিত অভ্যাস বজায় রাখা
- নিয়মিত ঘুম ও জাগরণ সময় স্থির করুন। সপ্তাহের প্রতিদিন একই সময় ঘুমাতে যান ও ওঠেন ।
- বেডরুম শুধুই ঘুম বা সেক্সের জন্য ব্যবহার করুন ,কাজ বা পড়াশোনার জন্য নয় ।
- ঘুমানোর ঘণ্টাখানেক আগে ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করুন ফোন/ল্যাপটপের আলো ঘুমের বিড়ম্বনা বাড়ায় ।
(খ) পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ
- ঘরের তাপমাত্রা ১৮–২২°C (৬৫ – ৭২°F) রাখুন; অনেক বেশি গরম বা ঠান্ডা হলে ঘুমে সমস্যা হয়
- শব্দ কম রাখুন—থাকলে হোয়াইট নয়েজ মেশিন বা কানদানি ব্যবহার করুন ।
- ঘরের বাতাস নতুন ও শুদ্ধ রাখুন—ভাল বেড ও শ্বাস-প্রশ্বাস যোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করুন ।
(গ) খাদ্য ও পানীয় সংক্রান্ত নির্দেশনা
- ক্যাফেইন, নিকোটিন ও অ্যালকোহল চিরতরে পরিহার করুন। রাতে ঘুমানোর ৪–৬ ঘণ্টা আগে নেবেন না।
- হালকা খাবার খান ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভারী খাবার গ্রহণ করলে ঘুমের বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
- পর্যাপ্ত ফল , সবজি ও জটিল শর্করা গ্রহণ করলে ঘুমের মান ভালো হতে পারে ।
(ঘ) শারীরিক কর্মকাণ্ড ও ব্যায়াম
- নিয়মিত ব্যায়াম ঘুমে সহায়তা করে—কিন্তু ঘুমানোর কমপক্ষে ২–৪ ঘন্টা আগে করুন ।
- যোগা, (Yoga) তাই চি (TaiChi) বা নিয়মিত হাঁটলে ঘুমের মান বেশ উন্নত হয় ।
(ঙ) মানসিক প্রশান্তি ও ক্রমাগত অভ্যাস
- পজিটিভ স্টিমুলাস—‘Stimulus Control’: বিছানায় ঘুম না হলে বের হয়ে শান্ত কাজ (যেমনঃ হালকা বই পড়া) চেষ্টা করুন। ।
- সবকিছুই পরিকল্পিতভাবে করুন পরের দিনের কাজ লিখে রাখুন। রাতে চিন্তা করে ঘুম নষ্ট করবেন না ।
- মনঃসংযোগ বা মেডিটেশন করুন । মাইন্ডফুলনেস বা ভালোবাসার মন্ত্র জপ করলে বা কোন সুন্দর কোন কিছু কল্পনা করলে মস্তিষ্ক শান্ত হয় ।
- প্রগ্রেসিভ মাসল রিলাক্সেশন (PMR) পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। প্রতিটি মাংসপেশী টানুন ও ছেড়ে দিন ।
- প্যারাডক্সিকাল ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন। ঘুমাতে ব্যর্থ হলে প্রচেষ্টা বন্ধ করুন। উদ্দেশ্যবহির্ভূত পরিকল্পিত ভাবে জাগ্রত থাকার চেষ্টা’ করুন। গবেষণায় দেখা গেছে এর মাধ্যমে ঘুম চাপ বেড়ে যায়।
(চ) প্রাকৃতিক সাহায্য টি, সাপ্লিমেন্ট ও অন্যান্য
- গরম দুধ, ক্যামোমিল চা, টাট চেরি জুস: এগুলো ট্রাইপ্টোফান বা মেলাটোনিন উৎস মানা হয়ে থাকে । ট্রাইপ্টোফান হলো অ্যামিনো অ্যাসিড যা শরীর তৈরি করতে পারে না , ডায়েট থেকে নিতে হয়। মেলাটোনিন হলো এক ধরণের হরমোন যা শরীরে তাপমাত্রা কমিয়ে ঘুমে সহায়তা করে।
- ল্যাভেন্ডার অয়েল ঘ্রাণ থেরাপি হিসেবে বা মালিশে নিদ্রা সহজ হয় ।
- ভ্যালেরিয়ান রুট হালকা ঘুম আনার জন্য ড্রিঙ্ক বা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে নিতে পারেন তবে এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন ।
- ম্যাগনেসিয়াম পেশী শিথিল করে ঘুমে সাহায্য করে ।
- মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট ভাল ঘুমে উপকার করে; তবে নিয়মিত একই ব্র্যান্ড নেবেন।
(ছ) পেশাগত বা থেরাপিউটিক সহায়তা
- কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT‑I): এ পদ্ধতি যা ঘুমের খারাপ অভ্যাস ও চিন্তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদি ভালো ফল দেয় ।
- স্লিপ রেস্ট্রিকশন থেরাপি:নিন্দ্রাহীনতা (insomnia) দূরীকরণের জন্য একটি প্রমাণিত আচরণ-ভিত্তিক চিকিৎসা। এটি গভীর ও অবিচ্ছিন্ন ঘুম বাড়ায়।
- অনলাইন CBT–I প্রোগ্রাম যেমন Sleepio তবে যারা নিজের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান ।
৩. ঘুম না হলে রাতে কী করবেন (পরবর্তী ধাপ)০৪
- সময়মতো স্টিমুলাস নিয়ন্ত্রণ করুন। যদি ২০–৩০ মিনিটে ঘুম না আসে, উঠে যান, অন্য শান্ত স্থিরভাবে অন্যকোন কোন কাজ করুন ।
- পরবর্তী দিনের চিন্তা আগেভাগে সাজান ও লিখে রাখুন ।
- বই পড়ুন, হালকা গান শুনুন বা ডায়েরি লিখুন দেখবেন মন ধীরে শান্ত হচ্ছে।
- বিছানায় ফিরে যান যখন বুঝবেন আস্তে আস্তে ঘুম আসছে।
- যদি ঘুম না আসে, তাহলে আবার একই প্রক্রিয়া শুরু করুন।
৪. ঘুম ভালো করার ১০টি টিপস
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান ও ওঠেন ।
- ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, নিকোটিন ঘুমের ৪–৬ ঘণ্টা আগে বন্ধ ।
- ঘরের পরিবেশ বিশুদ্ধ, শান্ত ও অন্ধকার রাখুন ।
- ঘুমে মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন/PMR/যোগা/তাইচি ব্যবহার করুন ।
- ঘুমাতে আগে ফ্যাস্ট-ফুড না খেয়ে, হালকা খাবার খান যাতে মন ও পেট শান্ত থাকে ।
- দিনভর আরাম পরিহার করুন। শারীরিক ব্যায়াম করুন, ঘুম ভালো হবে।
- ঘুম ভাঙলে বিছানা ছাড়ুন, অন্য কাজ করুন, ঘুম আসলে আবার বিছানায় ফিরে যান।
- গরম দুধ, ক্যামোমিল, টাট চেরি জুস, ল্যাভেন্ডার, ভ্যালেরিয়ান —ডাক্তার পরামর্শে গ্রহণ করুন।
- প্রয়োজনে CBT‑I বা Sleepio–মতো অনলাইন প্রোগ্রামে যোগ দিন ।
- ধৈর্য ধরুন এবং অভ্যাস পরিবর্তন করে নিজেকে বদলে ফেলুন।
শেষ কথা
ঘুম না হলে বা রাতে ঘুম ভাঙলে প্রথমে নিজের মধ্যে কয়েকটি সহজ পরিবর্তনে এনে
দেখতে পারেন। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের
পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন—পরিপাটি ঘুম মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য দুটোর
ক্ষেত্রেই একান্ত জরুরি। অভ্যাসের পরিবর্তন এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ
করে আপনার ঘুমের গভীরতা ও পরিমান বাড়াতে পারেন।। শুভ রাত্রি, মিষ্টি
স্বপ্নে ভরা ঘুম কামনা করছি।
স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url