লেবুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

 ভূমিকা

লেবু হলো  ছোট একটি খনিজ, ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল। এর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ভিটামিন সি, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন ও ক্ষতিকর মুক্ত র‍্যাডিকেল নিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।



এতে রয়েছে সাইট্রিক অ্যাসিড, পেকটিন (সলিউবল ফাইবার), পটাসিয়াম ও ফ্ল্যাভোনয়েডস যা হজম ও পেটের স্বাস্থ্যে সহায়তা করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং কিডনি পাথর রোধে কার্যকর । লেবুর স্বাদ শুধুমাত্র খাদ্যে স্বাদের মাত্রা বাড়ায় না, বরং এটি স্বাস্থ্যের নানা দিকেও নানাবিধ উপকার সাধন করে থাকে।


সূচিপত্র


লেবু  এক অপ্রতিরোধ্য পুষ্টির ভাণ্ডার ও সুস্থতার সঙ্গী

লেবুর পুষ্টিগুণ, তার ফ্লেভার, স্বাস্থ্য উপকারিতা ও নিরাপদ ব্যবহার নিয়েই আজকের আয়োজন।
পরিচিতি ও উপাদানলেবু (Citrus × limon) স্বাদযুক্ত সাইট্রাস ফল। এর রসে থাকে ৫–৬ % সাইট্রিক অ্যাসিড । এর পুষ্টিগুণগুলো নিম্নরূপ
  • লেবুতে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটিাসিন সি যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ত্বকের জন্য অপরিহার্য।
  • লেবুতে উপস্থিত পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
  • ভিটামিন B6, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফোলেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদান লেবুতে বিদ্যমান রয়েছে।এছাড়া বিশেষ ফাইটোকেমিক্যালস যেমন সাইট্রিক অ্যাসিড, হেস্পেরিডিন, ডিওস্মিন, এরিওসিত্রিন, D‑limonene সুস্থ্যতা ও রোগপ্রতিরোধে কার্যকর।

 স্বাস্থ্য উপকারিতা

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
লেবুতে প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ফ্রি র‍্যাডিকেল ক্ষয় রোধ করে এবং রোগ প্রতিহত করতে সহায়তা করে। লেবুর ভিটামিন C রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কারণ এটি শ্বেত রক্তকণিকাগুলোর কার্যকারিতা বাড়ায় এবং শরীরকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করে । এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফ্ল্যাভোনয়েডগুলো প্রদাহ কমিয়ে ইমিউন সিস্টেমকে আরও দৃঢ় করে।
ত্বকের যত্ন ও কোলাজেন সৃষ্টির সহায়ক
ভিটামিন সি ত্বকের কোলাজেন তৈরি এবং গ্লোয়িং ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।। এটি বার্ধক্য প্রতিরোধেও কাজ করে। লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে, যা ত্বকের কোলাজেন উৎপাদনে সহায়ক এই প্রোটিন ত্বককে নমনীয় ও বলিষ্ঠ করে, ফলে  তারুণ্য ধরে রাখা যায় ও বলিরেখা কমে যায়।  

ত্বকে লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিড মৃদুভাবে এক্সফোলিয়েশন করলে, মৃত কোষ সরিয়ে ত্বকে উজ্জ্বলতা আনতে সহায়তা করে । এছাড়া লেবুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ত্বকের কোষকে মুক্ত মৌল থেকে রক্ষা করে, যা অগ্রিম বয়সের চিহ্ন যেমন বলি রেখা ,শুস্ক ত্বক কমাতে সহায়তা করে।
হজম ও কিডনি পাথর রোধ
সাইট্রিক অ্যাসিড হজমে সহায়তা করে এবং প্রস্রাবে সাইট্রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে কিডনি পাথর গঠনের ঝুঁকি কমায়। লেবুর রস হজমে সাহায্য করে কারণ এতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড পেটে হজমজনিত রস (bile)  উৎপাদন বাড়িয়ে, খাদ্যের বিচ্ছিন্নতা ও পরিপাককে সহজ করে তোলে ।

এছাড়া, লেবুর উপস্থিত ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি হাঁড় স্বাস্থ্য ও হজমের জন্যও উপকারী । এদিকে, কিডনি পাথর রোধে লেবুর সাইট্রেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি ইউরিনে ক্যালসিয়াম আটকে পাথর জমাট বাঁধা থেকে আটকায়, ফলে নতুন পাথর গঠন বা বৃদ্ধির আশঙ্কা কমে যায়। লেবু পানি নিয়মিত পানে কিডনি আরও ভালোভাবে কার্যকর হয় এবং হজম-তন্ত্রও সুস্থ থাকে।
আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি
ভিটামিন সি নিরামিষ ভিত্তিক খাবার থেকে আয়রনের শোষণ বাড়ায়, ফলে রক্তাল্পতা ও ক্লান্তি কমে।লেবুতে প্রচুর ভিটামিন সি (অ্যাসকরবিক অ্যাসিড) ও সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে, যা আয়রনকে এমন এক রূপে রূপান্তরিত করে যেটি শরীর সহজে শোষণ করতে পারে ।

এছাড়া, গবেষণায় দেখা গেছে সাইট্রিক অ্যাসিড আয়রন শোষণে সরাসরি সহায়ক, যাতে আয়রন জমাট বাধা থেকে রক্ষা পায় এবং রক্তে প্রবেশ করা সহজ হয় ([turn0search1], [turn0search3])। তাই লেবুর রস বা লেবুর ব্যবহার খাবারের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে আয়রণ শোষণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ও রক্তচাপ ঠিক রাখতে সহায়ক
লেবুর ফ্ল্যাভোনয়েড ও পটাসিয়াম রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।লেবুতে প্রচুর ভিটামিন C, ফ্ল্যাভোনয়েড ও পটাশিয়াম থাকে, যা দেহে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও প্রদাহ কমাতে, রক্তনালীর নমনীয়তা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন C ও flavonoids (যেমন hesperidin) রক্তনালী প্রশস্ত করে, রক্তচাপ হ্রাসে সহায়তা করে । পটাশিয়াম অতিরিক্ত সোডিয়ামের প্রভাব কমিয়ে শ্বাসনালীতে চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে । এসব উপাদানের সংমিশ্রণ লেবু নিয়মিত গ্রহণ করলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা উন্নত হয় ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
কম ক্যালোরি ও ফাইবারযুক্ত লেবু ক্ষুধা কমায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।লেবু পানি খুবই কম ক্যালোরিযুক্ত পানীয় একগ্লাসে মাত্র কয়েক ক্যালোরি, যা সোডা বা জুসের বিকল্প হতে পারে। তবে ওজন বাড়ায় না । এটি পান করলে তৃষ্ণাকে ক্ষুধার ভাব কমে, ফলে খাবার কম খেতেও সাহায্য করে । এছাড়া, জলই হোক বা লেবু জল, পর্যাপ্ত হাইড্রেশন মেটাবলিজম বাড়াতে, ফ্যাট ব্রেকডাউন আরও ভালো করতে সাহায্য করে।
 দাঁতের গায়ে ক্ষতি (সতর্কতা)
অতি মাত্রায় লেবু বা লেবুর রস দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে এজন্য  অন্তত এক ভাগ রসের জন্য চার ভাগ পানি যুক্ত করুন যাতে অ্যাসিড কমে যায় । প্রয়োজনে লেবু জল পান করার জন্য স্ট্র ব্যবহার করুন। লেবু বা লেবু জল পান করার পর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে কুলকুচি করুন।

লেবুর খোসার উপকারিতা

লেবুর খোসা পুষ্টিতে ভরপুর এতে রয়েছে ভিটামিন A, C, ফ্ল্যাভোনয়েড, ডি‑লিমোনিন, পেকটিন (ফাইবার) ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
  • মুখের স্বাস্থ্য উন্নত, দুর্গন্ধ ও মাড়ির সংক্রমণ কমাতে পারে।
  • হজম শক্তি ও অন্ত্র সুস্থ্য রাখতে সহায়তা করে।
  • ওজন কমানো, হৃদরোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধেও লেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকর ভূমিকা রাখে। 

লেবুর ব্যবহার 

গরম/ঠাণ্ডা লেবু পানি
ঠান্ড লেবু পানি পানে স্বাচ্ছন্দবোধ হয় এবং হাইড্রেশন সহজ করার দিক থেকে জনপ্রিয়। সকালে কুসুম গরম লেবু পানি পান করলে হজম, হাইড্রেশন, ওজন নিয়ন্ত্রণে করে।গরম পানি লেবুর সঙ্গে মিশালে পাচনতন্ত্রকে উত্তেজিত করে, পাচনশক্তি বাড়ায় এবং অনিয়মিত হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।সকালে খালি পেটে গরম লেবুর পানি লিভারের কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে এবং শরীর থেকে টক্সিন বের হতে সহায়তা করে
রান্নায় ব্যবহার
সালাদ ড্রেসিং, মেরিনেড, ডেজার্ট, বেকিং, শরবত—সার্বজনীন স্বাদ যুক্ত করে। লেবু রান্নায় স্বাদের ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। মাংসের ম্যারিনেডে ব্যবহার করলে মাংস কোমল হয়, স্যুপ, সালাদ বা ডাল–ভাতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস খাবারের স্বাদ বদলে দেয়।। পাশাপাশি, কাটা ফল যেমন আপেল ও অ্যাভোকাডোর কালচে ভাব ঠেকাতে দিয়ে বিশেষ উপকারী। গৃহস্থালির কাজে যেমন লেবুর রস দিয়ে মাইক্রোওয়েভ পরিষ্কারসহ ফ্রিজ বা কাটিং বোর্ড থেকে দুর্গন্ধ দূর করা যায়। 
ত্বক ও চুলের যত্নে
মিশিয়ে ফেস মাস্ক বা হেয়ার টনিক হিসেবে ব্যবহার করা যায়; ব্রণের দাগ কমাতে সাহায্য করে।ভিটামিন C এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসমূহ ত্বকে উজ্জ্বলতা আনে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
হোম ক্লিনার ও ঘ্রাণ
লেবুর রস দিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা সহ বজায় রাথা সহ  ঘ্রাণ নির্গত হয় যা  essential oil aromatherapy তেও কাজে আসে । লেবুর তীব্র সার্জেন্টপূর্ণ অ্যাসিড ও তাজা সাইট্রাস গন্ধের কারণে এটি বাড়ির বিভিন্ন স্পটে ব্যবহারযোগ্য এক অনন্য  সুগন্ধযুক্ত প্রাকৃতিক ক্লিনার । লেবুর রস বা খোসার তেলের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল শক্তি দাগ, ও দুর্গন্ধ দূর করতে কার্যকর । লেবু  কৃত্রিম কেমিক্যাল বায়োমিশ্রণের চাইতে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।

আরো পড়ুনঃ লেবুর শরবত খাওয়ার উপকারিতা

 

ঘরোয়া টিপস ও সাবধানতা

  • দাঁতের এনামেল রক্ষা করতে লেবুর রস পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করুন এবং খাওয়ার পর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। লেবুর পানিকে দাঁতের সরাসরি সংস্পর্শ এড়াতে স্ট্র ব্যবহার করুন।
  • এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ভুগলে খালি পেটে লেবু পান করা থেকে বিরত থাকুন।
  • ফল/রসে এলার্জি থাকলে সাবধানতা জরুরি।
  • অতিরিক্ত লেবু ব্যবহারের ফলে দাঁত, গলার অসুবিধা হতে পারে সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

  উপসংহার  ০৭

পরিশেষে লেবু এমন এক স্বাস্থ্যকর উপাদান যা সহজেই প্রতিদিনের খাদ্য ও পানীয়ের সাথে যুক্ত করা যায়। এটি রোগ প্রতিরোধ, ত্বক, হৃদরোগ, হজম, কিডনি ও ওজন নিয়ন্ত্রণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কার্যকরী প্রভাব ফেলে । তবে এটির উচ্চ অ্যাসিডিক হওয়ায় অতিরিক্ত ব্যবহারে দাঁতের এনামেল ক্ষয় বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা হতে পারে, তাই পরিমিত ও যুক্তিযুক্তভাবে ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url