নারীদের হরমোন ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ ও প্রতিকার

 ভূমিকা

আপনার শরীর যদি কখনো ক্লান্ত, মেজাজ খিটখিটে, পিরিয়ড অনিয়ম হয়ে যাওয়া, এমন সব সমস্যা দেখা যায় তবে বলা যেতে পারে হরমোন ভারসাম্য নিয়ে সন্দেহ করা উচিত। হরমোন হলো আপনার শরীরের ‘রাসায়নিক বার্তাবাহক যেগুলো রক্তে চলাচল করে শরীরের বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করে  মাসিক, মেজাজ, ঘুম, , চুলের স্বাস্থ্য, ওজন ঠিক রাখে। 




ভারসাম্য নষ্ট হলে অনেক সমস্যা এক সাথে আসতে পারে। এখানে আলোচনা করব হরমোন ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার।

সূচিপত্র

হরমোন ভারসাম্য কী?

  • মানবদেহে প্রায় ৫০টির বেশি হরমোন রয়েছে যেগুলো সময়ে সময়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিঃসরিত হতে হয়। এদের সঠিক সামঞ্জস্য মানেই হরমোনাল হোমিওস্ট্যাসিস।
  • যদি কোনো হরমোন বেশি বা কম নিঃসৃত হয়, যেমন ইস্ট্রোজেন বেশি হলে ব্রণের সমস্যা, প্রজেস্টেরোন কম হলে পিরিয়ড অনিয়ম হতে পারে। একইভাবে কোর্টিসল বেশি হলে ক্লান্তি, মানসিক চাপ বাড়তে পারে।
  • তাই সাধারণভাবে হরমোন ভারসাম্যহীনতা বলতে বোঝায় হরমোনের সঠিক মাত্রা না থাকা  যার প্রভাব শরীরের একাধিক অংশে পড়ে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

ক্লান্তি ও শক্তিহীনতা
  •  সারাদিন ক্লান্তিভাব, বিশ্রাম ও খাবারের পরেও  শরীরে শক্তি ফিরে না আসা
  • হার্ট স্পন্দন ওঠানামা , ঠান্ডা/গরমে সহনীয়তা হারানো, বা বদলে যাওয়া রক্তচাপ– এগুলোর সম্ভাবনা থাকে ।
মেজাজ পরিবর্তন ও বিষণ্নতা
  • হঠাৎ খিটখিটে বা দুঃখ-উদাসীনতা, কোন বড় কারণ ছাড়াই উদ্বেগ ভাব
  • প্রি‑মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (PMDD) হলে এ ধরনের মেজাজের ওঠানামা গড়পড়তা নয়, বরং কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে।
ওজন ও কোষ্ঠ সমস্যা
  • অনিচ্ছাকৃত ওজন বৃদ্ধি, বিশেষ করে কোমরের চারপাশে চর্বি জমা হওয়া।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া, অতিরিক্ত পিপাসা, বারবার প্রস্রাব, ঘন ঘন জলপিপাসা  ইনসুলিন বা অ্যাড্রেনাল হরমোনের মতো মেটাবলিক হরমোনের ছাপ হতে পারে। [turn1search2]
ত্বক ও চুলের সমস্যা
  • ব্রণ হওয়া, তেলঝরা বা শুকনো ত্বক, আঁচিল এসব ভিন্ন হরমোনের ভারসাম্য ঘাটতি নির্দেশ করে।
  • পিসিওএস–এ (PCOS) মুখ, ছাতি, পিঠে ব্রণ, গালে ও দাড়িতে অতিরিক্ত লোম, চুল পড়া ইত্যাদি সমস্যা হয়।
মাসিক চক্রের অস্বাভাবিকতা ও বন্ধ্যাত্ব
  • মাসিক অনিয়ম: দেরিতে আসা, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
  • PCOS বা থাইরয়েড ইস্যুর কারণে ডিম্বস্ফোটনে সমস্যা হলে বন্ধ্যাত্ব বেড়ে যেতে পারে।
  • যৌন চাহিদা হ্রাস, শুষ্কতা, কামশক্তি কমে যাওয়াও হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে।
ঘুমে সমস্যা ও হট ফ্ল্যাশ
  • অনিদ্রা, ঘুম না আসা বা রাতে বারবার ঘুম ভাঙা।
  • মেনোপজের আগে বা পিরিয়ডের আগে হঠাৎ গরম লাগা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
এসব উপসর্গ যদি একাধিক সময় ধরে অনুভব হয়, তবে অবহেলা করবেন না। কারণ হরমোনাল সমস্যা (যেমন PCOS, থাইরয়েড, আমেনোরিয়া, PMDD) কম সময়ে সনাক্ত করা গেলে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

কারণসমূহ

ক্রনিক মানসিক চাপ ও কোর্টিসল এর ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে ইমোশনালি বা মানসিক চাপ থাকলে কোর্টিসল মাত্রা বেড়ে যায় এবং শরীরের রেজিস্ট্যান্স হরমোনগুলো বিজড়িত হয়।
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা
  • অধিক পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড এগুলো ইনসুলিন প্রতিরোধ বাড়িয়ে দেয়।
  • Omega‑3 কম, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল (যেমন D, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক) কম হলে হরমোনাল ভারসাম্য হারাতে পারে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া এবং ব্যায়ামের অভাবও হরমোনে  ভারসাম্যহীনতার ক্ষেত্রে  প্রভাব রাখে।
পিসিওএস (PCOS)
  • এই সমস্যা হলে শরীর গ্লুকোজ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, ফলে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ইনসুলিন অতিরিক্ত পুরুষ হরমোন তৈরি করে ।অধিক পরিমাণে এন্ড্রোজেন (যেমন টেস্টোস্টেরন) ডিম্ববিকাশ ও ঋতুস্রাব প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
থাইরয়েড রোগ
  • হাইপোথাইরয়ডিজম বা হাইপারথাইরয়ডিজম হলে মেটাবলিজম, ওজন, ক্লান্তি ও মানসিক অবস্থা প্রভাবিত হতে পারে।
মেনোপজ ও বয়সজনিত পরিবর্তন
  • বয়স বাড়ার সঙ্গে ইস্ট্রোজেন‑প্রজেস্টেরনের ওঠানামা দেখা দেয়, বিশেষত মেনোপজ পর্যন্ত। ফলে গরম ঝলকানি, কার্টিসল বৃদ্ধি, ঘুমে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পরিবেশগত ও জিনগত কারণ
  • প্লাস্টিক (BPA), কীটনাশক, প্যারাবেন প্রভৃতি হরমোন বিঘ্নকারী রাসায়নিক শরীরে এন্ডোক্রাইন ডিসরাপশন ঘটাতে পারে। এন্ডোক্রাইন ডিসরাপশন (Endocrine disruption) বা হরমোনগত ব্যাঘাত হলো এমন এক অবস্থা যেখানে শরীরে বাইরে থেকে আসা কোনো রাসায়নিক বা পদার্থ হরমোন সিস্টেমে হস্তক্ষেপ করে, ফলে শরীরের হরমোন উৎপাদন, সঞ্চালন বা কাজের পদ্ধতিতে ব্যাঘাত ঘটে এই প্রক্রিয়াই এন্ডোক্রাইন ডিসরাপশন।
  • পিতামাতার কোনো হরমোনজনিত রোগ থাকলে জেনেটিক ঝুঁকি বেশি থাকে।

প্রাকৃতিক প্রতিকার ও জীবনধারার পরিবর্তন

সুষম খাদ্য
  • Omega‑3 ভরা মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড, বাদাম, এভোকাডো; Cruciferous ভেজিটেবল (ব্রকোলি, ফুলকপি) ইস্ট্রোজেন মেটাবলিজমে সহায়ক
  • সম্পূর্ণ শস্য, শাক-সবজি, ফল, স্বাস্থ্যকর চর্বি ও প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করুন; চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমান।
সুন্দর ঘুম ও স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ
  • প্রতিদিন ৭‑৮ ঘণ্টা গুণগত ঘুম নিশ্চিত করুন। স্ক্রিন টাইম কমান‌, ঘুমের আগে বাড়িতে মোবাইল, ল্যাপটপ বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন।
  • মাইন্ডফুলনেস, ধ্যান, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস— এ গুলো নিয়মিত করতে পারেন যা আপনার  মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
 নিয়মিত ব্যায়াম
  • সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মডারেট এক্সারসাইজ: হালকা হাঁটা, যোগ, সাইক্লিং বা ওজন উত্তোলনকরতে পারেন এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় ও কোর্টিসল নিয়ন্ত্রণে রাখে।
 ভেষজ ও অতিপ্রাকৃতিক সংযোজন
অশ্বগন্ধা (Ashwagandha) – একটি adaptogen যা HPA axis‑কে স্থিতিশীল রাখে, কোর্টিসল কমায়  থাইরয়েড ও প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যে উন্নতি  ঘটায়।
Vitex agnus‑castus (চেস্টবেরি বা চেস্ট ট্রি)  এটি হলো একটি উদ্ভিজ্জ ঔষধ, যা PMS ও PMDD-এর জন্য ঐতিহ্যবাহীভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রোল্যাকটিন কমিয়ে, প্রোজেস্টেরন ও এস্ট্রোজেনের ভারসাম্যে কাজে লিপ্ত হয় বলে ধারণা করা হয়।
মাক রুট, রেড ক্লোভার, রোডিওলা, হোলি বেসিল (Tulsi) – প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে সাহায্য করে, তবে কোনো নতুন supplement শুরু করার আগে ডাক্তার বা পুষ্টিবিদকে জিজ্ঞাসা করুন।

চিকিৎসা ও হেলথকেয়ার পদ্ধতি 

হরমোনিভিত্তিক সমস্যার রক্তপরীক্ষায় আছে থাইরয়েড (TSH/T3/T4), প্রোল্যাকটিন, ইস্ট্রোজেন‑প্রজেস্টেরন‑টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি। PCOS‑র জন্য USG করা হয় ওভারির স্বাস্থ্য যাচাইয়ের জন্য।
 চিকিৎসা পদ্ধতি
  • হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (HRT): যদি মেনোপজ বা ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন কম থাকে, তবে HRT উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগে। তবে এর ঝুঁকি আছে  যেমন ক্যান্সার বা কার্ডিওপ্রোব্লেম হতে পারে।
  • Combined Oral Contraceptive Pills (COCP) বা কোম্বাইন্ড জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের   PCOS‑এ মাসিক নিয়ন্ত্রণ, ব্রণ ও অতিরিক্ত লোম (হাইরটিজম) নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়।
  • থাইরয়েড ওষুধ: হাইপোথাইরয়ডিজম হলে লেভোথাইরোক্সিন দেওয়া হয়; হাইপারথাইরয়ডিজমে এন্টিথাইরয়েড ওষুধ।
  • প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সার্জারি— যেমন, পিটুইটারী অ্যাডেনোমা বা ওভারীয় সিস্ট অপসারণ।
শারীরিক ও মানসিক সহায়তা
  • PCOS‑এ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে Metformin বা GLP‑1 agonist ও কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টি‑অ্যান্ড্রোজেন ওষুধ দেওয়া হয়। ওজন কমানো ও ডায়েট উপশমের পরামর্শ থাকে।
  • PMS বা PMDD হলে এন্টিডিপ্রেসেন্ট (SSRI), ব্র্যাচ ট্রি বেরি (Vitex), কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি কাজে লাগে।

কখন ডাক্তার দেখাবেন ?

  • যদি  দেখেন কয়েক সপ্তাহ সমস্যা কাটছে না এবং প্রতিদিনের জীবনে প্রভাব ফেলছে। (যেমন: কাজের শক্তি নেই, মেজাজ খারাপ, শরীরের গরম লাগছে, পিরিয়ড অনিয়মিত ইত্যাদি)।
  • মাসিক ৩ মাস পরপর বিলম্বিত হয় বা এক মাস রক্তক্ষরণ বেশি, মেয়াদহীন হয়ে যাচ্ছে (amenorrhea)
  • দ্রুত ওজন বৃদ্ধি বা হঠাৎ কম যাচ্ছে।
  • যদি আপনি সিন্থেটিক হরমোনে যোগদান (HRT/দীর্ঘদিন (৫+ বছর) ব্যবহারের ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বৃদ্ধি পায় প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে অবশ্য  তা নির্ভর করে বয়স ও সময়ের ওপর।

উপসংহার

হরমোন ভারসাম্যহীনতা মহিলাদের জন্য অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সচেতনতা, সঠিক খাদ্য, পরিমিত ব্যায়াম, স্ট্রেস কমানো ও প্রয়োজনে মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। 

আপনার স্বাস্থ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ্যতা     চাইলে আজই শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি নিন। সুস্থ খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, স্ট্রেস‑ফ্রি জীবন ও প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আপনার শরীরের সুস্থ্যতার প্রথম দায়িত্ব আপনার নিজের। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url