“বজ্রপাতের সময় আপনার নিরাপত্তা: প্রথম প্রতিরক্ষা”

    বজ্রপাত কি? 

বজ্রপাত (Lightning & Thunderstorm) হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক ঘটনা  যেখানে মেঘে জমে থাকা ঋণাত্মক (negative) ও ভূমি বা মেঘের উপরের ধনাত্মক (positive) চার্জের পার্থক্য হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়ে, তা থেকে উদ্ভূত হয় এক মুহূর্তের ভয়ানক বিদ্যুৎ প্রবাহ।



বৈজ্ঞানিক ভাষায় এটাকে বলা হয় Lightning Discharge। ঝড়ের পুন্জিভূত মেঘ (Cumulonimbus) যখন খুব বেশি আর্দ্রতা ও তাপ পায়, তখন তা ভেতরে ছড়িয়ে  চার্জ তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে তা বিকট শব্দে  ঝাপটে বিদ্যুৎ আকারে ভূপৃষ্ঠ বা কাছাকাছি অন্য মেঘে সঞ্চালিত হয়।

সূচিপত্র ঃ


বজ্রপাতের কারণ

১.আবহাওয়া-বৈচিত্র্য
বাংলাদেশসহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে গরম বায়ু উপরে ওঠে, সাথে থাকে আর্দ্রতা। গরম বায়ু তুলনামূলকভাবে হালকা ও আর্দ্র হয় যা ঠান্ডা বায়ুর তুলনায় কম ঘনত্বের। যখন গরম বায়ু ঠান্ডা বায়ুর সাথে মিশে, ঠান্ডা বায়ু নিচে গিয়ে গরম বায়ুকে উপরে ঠেলে, যা বায়ুমণ্ডলে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই অস্থিরতা মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত বা ঝড়ের মতো আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
২.চার্জ বিভাজন
বরফের কণা ও জলবিন্দুর সংঘর্ষে মেঘের অভ্যন্তরে নানা স্থানীয় চার্জ বিভাজন হয় ঋণাত্মক ও ধনাত্মক চার্জের সৃষ্টি হয়। এ পার্থক্য যত বেশি হয়, বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বাড়ে ।

৩.জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে বাতাস গরম হচ্ছে, তাই তাপমাত্রা বাড়ছে ,গরম বাতাসে ৭% বেশি পানি ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে প্রতি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে অর্থাৎ, গরমে বাতাসে ভাপ জমে যায় বেশি মেঘ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও তাই বেড়ে যায়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রাও বাড়ছে ফলে বেশি বাষ্প গঠন ও ভেজা বাতাস তৈরি হচ্ছে, যা উত্তর দিকে ভ্রমণ করে। এদিকে উত্তরের শুষ্ক ও ঠাণ্ডা হাওয়া দক্ষিণের ভেজা বাতাসের সাথে মিশছে। এই সংঘর্ষে মেঘ ও বাতাসের স্তর দ্রুত কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে, মেঘ উপরে উঠে ঠাণ্ডা হয়ে ঘনীভূত হয়ে বজ্রমেঘ গঠন শুরু হয় এবং বজ্রপাতের সম্বাবনা বাড়ে।


বজ্রপাত থেকে কীভাবে বাঁচবেন — নিরাপদ পরামর্শ

ধরে নিন কোন অপ্রত্যাশিত বজ্রঝড় কিংবা বজ্রপাত শুরু হয়ে গেছে এমতবস্থায়  আপনি কি করবেন?

১.পাকা বাড়ি বা পাকাবাড়ির নিচে যান
খোলা ও মুক্ত স্থান এড়িয়ে চলুন। বাংলায় “পাকা বাড়ি” বলতে সাধারণত বোঝানো হয় ইট বা কংক্রিটের তৈরি পূর্ণগৃহ সহ আর্থিং ও সুরক্ষিত ছাদ, এমন জায়গায় অবস্থান নিন । আর্থিং বা গ্রাউন্ডিং মানে হলো বাড়ির বৈদ্যুতিক সিস্টেমকে সরাসরি মাটির সাথে ধাতব তার বা রডের মাধ্যমে সংযুক্ত করা। এর ফলে বাড়িতে অথবা সিস্টেমে কোনো অতিরিক্ত চার্জ বা বৈদ্যুতিক ফাঁদ জমে থাকলে তা নির্দিষ্টভাবে মাটিতে চলে যায় ।। এমন বাড়ি বজ্রপাতের সময়  সুরক্ষা দেয়।
২.গাড়ির ভেতরে থাকা নিরাপদ
গাড়ী থেকে নামবেননা গাড়ীর ভেতরে থাকুন তবে জানালা বন্ধ রাখুন এবং ধাতব অংশ স্পর্শ করবেন না। গাড়ি এক্ষেত্রে একটি ফ্যারাডে' খাঁচার মতো কাজ করবে।
৩.ধাতব ও পানি থেকে দূরে থাকুন
ধাতু (কল, সিঁড়ি রেলিং, পাইপ) স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।পানি, ঝর্ণা, পুকুর, সেতু এগুলি এড়িয়ে যান, কারণ পানি বৈদ্যুতিক পরিবাহী । বজ্রপাতের সময় স্নান বা অল্প পানি ব্যবহারেও বিপদ হতে পারে।
৪.বিদ্যুৎ সংযুক্ত যন্ত্র বন্ধ করুন
TV, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোনের প্লাগ খুলে ফেলুন। রান্নাঘরে পানি দেওয়া, স্নান করা এড়িয়ে চলুন, কারণ  বৈদ্যুতিক তার এটি ছড়িয়ে দিতে পারে ।

৫.গাছ বা উঁচু জায়গায় থাকবেন না
গাছ, খুঁটি, টাওয়ার, উঁচু বেড়া—সব ধরনের উচ্চতার  দাঁড়াবেন না। গাছের নিচে আশ্রয় নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে, কারণ গাছের শীর্ষে বিদ্যুৎ পতিত হলে, এটি গাছের মূল বা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

৬.খোলা জায়গায় থাকলে করণীয়
নিজেকে নিচু রেখে বসে যান । গুটিয়ে মাথা নিচু করে হাত দিয়ে মাথা ঢেকে বসুন, তবে মাটিতে শুয়ে পড়বেন না, কারণ মাটি দিয়ে বৈদ্যুতিক চার্জ ছড়িয়ে যেতে পারে।
৭.বাড়ীর ভিতরে থাকলে
জানালা থেকে দূরে থাকুন, জানালা বন্ধ করে রাখুন। কংক্রিট বা লাল ইট বিল্ডিং নিরাপদ, তবে ভিতরে যেন লোহা বা স্টিল দিয়ে আর্থিং করা রড থাকে এতে বজ্রপাত গৃহে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে বিদ্যুৎ মাটি পর্যন্ত যায়।

৮.ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম থেকে দূরে
মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহারে সমস্যার সৃষ্টি হয়না তবে কর্ডেড ফোন বা প্লাগ-যুক্ত যন্ত্র কখনো ব্যবহার করবেন না। প্লাগ খুলে রাখুন, বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ রাখুন।
৯.আহত হলে করণীয়
বজ্রপাতে আহত হলে খালি হাতে স্পর্শ না করে শুকনো কাঠ দিয়ে অথবা প্লাস্টিক রশি দিয়ে সরান ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ রোধে এ কাজ নিরাপদ। শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্র সচল, কিনা পরীক্ষা করে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান।

সর্তকতা ও প্রাক-সতর্কতা

স্থানীয় আবহাওয়া অধিদফতরের  সকল আপডেট সম্পর্কে সতর্ক নজরে রাখুন কারণ ঝড়–বৃষ্টির আগেই পূর্বাভাস মেলে।বাড়িতে বা কর্মস্থলে আয়রন রড–সহ গুরুত্বপূর্ণ আর্থিং ব্যবস্থা রাখুন, তবে এটি অবশ্যই যোগ্য ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে সঠিকভাবে করা উচিত। সর্তকতার ক্ষেত্রে স্মার্ট অ্যালার্ট বা মোবাইল সতর্কতা সফটওয়্যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।বজ্রপাতে আকাশ চমক–অবয়ব (flash) ও গর্জন (boom) এর মধ্যে ৩০ সেকেন্ডের কম সময় হলে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় নিন।

শেষ কথা

বজ্রপাত হলে অবিলম্বে মজবুত কোনো ঘর বা গাড়ির ভিতরে ঢুকে নিন, এবং জানালা, দরজা, ধাতু বা খোলা অংশ থেকে দূরে থাকুন । একান্ত প্রয়োজনে গাড়িতে থাকলে জানালা বন্ধ রাখুন, ধাতু স্পর্শ করবেন না । খোলা মাঠে থাকলে নিচু হয়ে বসে, কান ঢেকে “৩০-৩০ নিয়ম” মেনে বজ্রপাত ও গর্জনের মধ্যে সময় গুণে কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড পর আশ্রয় পরিবর্তন করুন । তাছাড়া পানি, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি ও ধাতব পাইপ থেকে দূরে থাকুন, এবং ঘরে বৈদ্যুতিন যন্ত্র unplug করুন । কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে অবিলম্বে CPR দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান । এই গুরুত্বপূর্ন সতর্কতা মেনে চললে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমে যায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url