ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে, তথ্যের নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা
জাতীয় অগ্রগতির অন্যতম সূচক। বাংলাদেশে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” মিশন বাস্তবায়নের
প্রেক্ষাপটে ব্লকচেইন প্রযুক্তি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির সঠিক
ধারণা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা এখনও সীমিত ।
অনেকেই কেবল ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ কিংবা ‘বিটকয়েন’ পর্যন্ত বিষয়টিকে
সীমাবদ্ধভাবে বোঝে। তবে এর ব্যবহারযোগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সঠিক ধারণা থাকা
জরুরি।
১. ব্লকচেইন কী ও কীভাবে কাজ করে?০২
ব্লকচেইন হলো এক ধরনের বিতরণকৃত লেজার (ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলজি, DLT),
যেখানে তথ্য ব্লকে সাজানো হয় এবং ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশের মাধ্যমে প্রতিটি ব্লক
পরবর্তী ব্লকের সাথে যুক্ত থাকে, ফলে একবার ব্লকে লেখা তথ্য পরিবর্তন প্রায়
অসম্ভব হয়ে ওঠে ।
কীভাবে কাজ করেঃ
ক) কনসেনসাস মেকানিজমঃ যেমন PoW, PoS দিয়ে নেটওয়ার্ক গঠন করা
হয় যা ব্লকের যথাযথতা নিশ্চিত করে।
খ) ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশিংঃ নিশ্চিত করে তথ্যের অখণ্ডতা ও
নিরাপত্তা ।
২.বাংলাদেশে ব্লকচেইনের প্রচলিত ও সম্ভাব্য ব্যবহার
ভূমি রেজিস্ট্রি
বাংলাদেশে ভূমি নিবন্ধনের কার্যক্রম দুর্নীতি ও জটিলতায় ভরা। ব্লকচেইন
প্রযুক্তি প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও খণ্ডিত তথ্য পরিবর্তন থেকে লেনদেনকে রক্ষা করা
যায় – এ প্রযুক্তির অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র ।
সরকারি ডকুমেন্ট যাচাই
জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম–মৃত্যু প্রত্যয়ন, একাডেমিক সার্টিফিকেট জাতীয়
গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের অনলাইন যাচাই সহজ এবং নিরাপদ করতে ব্লকচেইন কাজে
লাগানো যেতে পারে ।
ই‑ভোটিং
ভোটারদের ভোট দান ও গণনা স্বচ্ছ ও খোলাখুলিভাবে, প্রকাশ্য হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
যদিও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, ভবিষ্যতে ভার্চুয়াল ভোটিংয়ে এই প্রযুক্তি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ।
আর্থিক খাত
রেমিট্যান্সঃ
ব্লকচেইন দ্বারা পিয়র-টু-পিয়র ভিত্তিতে দ্রুত, কম খরচে অর্থ পরিবহন
সম্ভব ।
লেনদেন ও স্মার্ট কন্ট্রাক্ট
ব্যাংকিং লেনদেন, এলসি নিষ্পত্তি, দায়বদ্ধ স্মার্ট কন্ট্রাক্ট প্রক্রিয়া আরও
দ্রুত ও নিরাপদ ।
সাপ্লাই চেইন ও কৃষি
কৃষিতে ব্লকচেইন দিয়ে “ফার্ম টু ফোর্ক” ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত হয়। এটা কৃষিজাত
পণ্যের উৎস ও প্রক্রিয়া যাঁচাই করতে সাহায্য করে ।ফসলের প্রতিটি পর্যায়
যেমন উৎপাদন, প্যাকেজিং, পরিবহন একটি ইউনিক কোডের মাধ্যমে ব্লকচেইনে লেনদেন
হিসেবে রেকর্ড হয়।এতে বিদেশি ক্রেতা ও ভোক্তা খুশি থাকে কারণ তারা নিশ্চিত
হতে পারে যে পণ্য ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া নিরাপদ আছে।
৩.সরকারী নীতি গঠনের উদ্যোগ
জাতীয় ব্লকচেইন স্ট্র্যাটেজি (২০২০)
সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশে” ব্লকচেইনকে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে ধরেছে। এতে
বিভিন্ন খাতে কর্মপরিকল্পনা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিকল্পনা
রয়েছে ।
বিসিসি (BCC): ব্লকচেইন প্রকল্প বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন ও পাইলট
কর্মসূচি চালাচ্ছে।
৪. বাংলাদেশের বাস্তব সীমাবদ্ধতা
৪.১ বেশিরভাগ মানুষের কাছে ব্লকচেইন মানেই শুধু ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’। তবে এর
বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা কম।
৪.২ দেশে পর্যাপ্ত ব্লকচেইন ডেভেলপার ও এক্সপার্ট নেই; অনেকেই এখনও প্রাথমিক
পর্যায়েই রয়ে গেছে।
৪.৩ গ্রামগঞ্জে ইন্টারনেট স্পিড ও স্থায়িত্ব কম হওয়ায় ব্লকচেইন চালাতে সমস্যা
হয়।
৪.৪ প্রতি প্রকল্পে ৳৫,০০,০০ থেকে ৳২,০০,০০,০০০ খরচ হতে পারে — ছোট ও মাঝারি
প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অনেক সময় তা বহনযোগ্য নয় ।
৪.৫ তথ্য immutable হলেও ম্যালওয়ার বা হ্যাকার থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা
চ্যালেঞ্জ ।
৪.৬ জনসাধারণ ব্লকচেইনে তথ্য মানুষজন দেখতে পায়, এতে গোপনীয়তা সমস্যা
দেখা দিতে পারে।
৪.৬ বিভিন্ন ব্লকচেইন পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, যা বড় সিস্টেমে যুক্ত
করতে সমস্যা ।
৪.৭ বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। যদিও ব্লকচেইনের
নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে এখনও স্পষ্ট নীতিনির্দেশনা প্রকাশ হয়নি ।
৫. সীমাবদ্ধতার অতিরিক্ত মাত্রা
৫.১ইন্টারফেস ও ব্যবহারের সহজতা না থাকায় সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চলে ।
৫.২ বিশ্বব্যাপী ব্লকচেইন প্রতিনিয়ত কয়েকটি ট্রানজেকশন/সেকেন্ডে (৩–৩০ TPS)
প্রসেস করে; তবে বাংলাদেশের পরিসরে তা যথেষ্ট নয় ।
৫.৩ PoW ভিত্তিক ব্লকচেইনগুলো (যেমন বিটকয়েন) অত্যন্ত বেশি বিদ্যুৎ খরচ
করে—বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ।
৫.৪ ব্লকচেইন ভিত্তিক সিস্টেমে তথ্য সংশোধন না করে ‘রাইট টু বিঙ্গ’ বা
মানবাধিকার দায় নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
৬. সমাধান ও সুপারিশ
৬.১ ব্লকচেইন বিষয়ক কর্মশালা, মিডিয়া প্রচার, কোর্স ও সাধারণ উপলব্ধির
প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে ।
৬.২ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ব্লকচেইন কারিকুলাম যুক্ত ও
ব্র্যাক-বিসিসি-সহ প্রশিক্ষণ বাড়ানো হবে ।
৬.৩ রুরাল ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়ন, ডাটা সেন্টার নির্মাণ ও সাইবার সুরক্ষা
ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে ।
৬.৪ ইন্টারফেস সহজ করা, ত্রুটি সংশোধন ও নিরাপত্তা বজায় রেখে ব্যবহারযোগ্যতা
বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।
৬.৫ ক্রিপ্টো নিষেধ হওয়া সত্ত্বেও ব্লকচেইন নির্বিঘ্নে চালাতে স্পষ্ট
নীতিমালা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক নিয়ম প্রণয়ন জরুরি ।
৬.৬ রাজধানীতে ভূমি রেজিস্ট্রি, লেনদেন, স্মার্ট কন্ট্রাক্ট পাইলট প্রজেক্ট
চালানো যেতে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান সাথে
সহযোগিতার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা প্রাসঙ্গিক ।
৭. ভবিষ্যতে সম্ভাবনা
৭.১ রিমিট্যান্স ও ডি-ফাই প্ল্যাটফর্ম গ্রামীণ মানুষের কাছে আর্থিক পরিষেবা
অনায়াসেই পৌঁছে দিতে পারে ।
৭.২ স্বতন্ত্র সনদ যাচাই, ভূমি নিবন্ধন ইত্যাদি ব্লকচেইনের সাহায্যে আরও
নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত হতে পারে।
৭.৩ নতুন ব্লকচেইন স্টার্টআপ সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আসা সম্ভাবনাকে
বাড়াতে পারে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বহুমাত্রিক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। ল্যান্ড
রেজিস্ট্রি, স্মার্ট ডকুমেন্ট, রিমিট্যান্স, কৃষি পাঠ্যক্রম, ব্যাংকিং সকল
ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ইতিবাচক। তবে সচেতনতা, দক্ষতা, নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো ও
উপযোগী নীতিমালা না হলে এগুলো এক্সপোনেনশিয়াল প্রভাব ফেলে না।
একথা নিশ্চিত যে:
-
জনসচেতনতা ও প্রশিক্ষণ
বাড়াতে হবে,
-
ইন্টারফেস সহজ ও নিরাপদ
করতে হবে,
-
ইন্টারঅপারেবিলিটি নিশ্চিত
করতে হবে,
-
এবং
আইনি বাধা দূর করতে
হবে।
সঠিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাওয়ায় ব্লকচেইন বাংলাদেশকে ডিজিটাল ব্যাংকিং উপযোগী
একটি কালচার তৈরি করতে পারে যেটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, দক্ষতা ও সিস্টেমের
উন্নয়নকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url