বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সেবার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ভূমিকা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অবকাঠামো, বিশেষ করে গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। দেশের প্রায় ৭৭% মানুষ গ্রামে বসবাস করেন, যেখানে যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে ।বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন বা দূরবর্তী চিকিৎসা সেবা এমন এক প্রযুক্তিগত  দিগন্ত খুলে দিয়েছে যা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে নতুন এক অগ্রযাত্রার সূচনা করেছে। 



এই প্রযুক্তি হাসপাতালে যাওয়ার ঝামেলা, সময় ও খরচ অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। COVID‑19 মহামারী দিনে এটিই হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা মাধ্যম যেখানে ঘরে বসেই সুরক্ষিত চিকিৎসা পরামর্শ নেয়ার সুযোগ তৈরি করে । এই ব্লগে আলোচনা করা হবে দেশের বাস্তবতা মিলিয়ে প্রযুক্তির সুবিধা, সীমাবদ্ধতা এবং আগামী দিনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে ।বর্তমানে টেলি-কার্ডিওলজি, টেলি-প্যাথলজি, টেলি-নার্সিং, টেলি-ফার্মেসিসহ স্বাস্থ্যসেবার অনেক বিভাগ ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে।

সূচিপত্র

টেলিমেডিসিন কি?

টেলিমেডিসিন (Telemedicine) হলো এমন একটি আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি, যেখানে রোগী ও চিকিৎসক শারীরিকভাবে একই স্থানে না থেকেও ইন্টারনেট, ভিডিও কল, ফোন কল বা মেসেজিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ, ডায়াগনোসিস ও ফলো‑আপ চিকিৎসা গ্রহণ করেন।এক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসক সরাসরি না মিশে ভিডিও/অডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে।ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সবই করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে দূরবর্তী অঞ্চলের রোগীরা বিদেশি বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ঘরে বসেই পেতে পারেন ।


টেলিমেডিসিনের প্রধান সুবিধা

১.টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় গ্রামীণ অথবা দূরবর্তী স্থানে থেকেও যাত্রা, সময় ও খরচ এড়িয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে নেয়া যায়।
২.টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় ভিডিও বা অডিও কনসাল্টেশনে রোগী হাসপাতালে না গিয়েও চিকিৎসা সেবা পেয়ে যায় ।
৩.COVID‑19‑এর মত যেকোন মহামারী পরিস্থিতিতে চেম্বারে না গিয়েই টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা যায় যাতে করে রোগী ও ডাক্তার উভয়ের নিরাপদ থাকতে পারেন।

করোনা সময়ে কুর্মিটোলায় জেনারেল হাসপাতালের “স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩” প্ল্যাটফর্ম প্রায় ১৫ লাখ মানুষের চিকিৎসা দিয়ে ইতিহাস গড়েছিল।গ্রামীণফোন, টনিক, ডাক্তারভাই এর মতো উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে ভার্চুয়াল স্বাস্থ্যসেবা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়া টেলি-কার্ডিওলজি, টেলি-প্যাথলজি, টেলি-নার্সিং, টেলি-ফার্মেসিসহ স্বাস্থ্যসেবার অনেক বিভাগ ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে।

টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় প্রধান চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

১.দেশের অনেক গ্রামে উচ্চ-গতির ইন্টারনেট নেই; ২G/৩G-র উপর নির্ভরতা সেবা প্রদান ও কনসাল্টেশনকে জটিল করে তোলে ।
২. নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব অনেক জায়গায় সমস্যার সৃষ্টি করে ।
৩.বয়স্ক বা অল্প শিক্ষিত রোগীরা ডিজিটাল উপায়ে পরামর্শ নিতে ভয় পায় তারা এ বিষয়ে খুব বেশী জানে না।
৪.মোবাইল-অ্যাপের ব্যবহার যোগ্যতা  কম এবং অ্যাপের অপারেটিং সিস্টেম  বাংলা ভাষায় না থাকার কারণে  গ্রামীণ মানুষের টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবা বুঝতে সমস্যা হয়।
৫.রোগীর তথ্যের সুরক্ষা দেয়া, গোপনীয়তা ও তথ্য লঙ্ঘন এই ঝুঁকিগুলো এড়াতেই টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় উন্নত সর্তকতামূলক ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার।
৬.টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় ভার্চুয়াল কনসাল্টেশনে অনেকেই ডাক্তারের সাথে সরাসরি দেখা না করায় আস্থা হারান।
৭.কিছু রোগীর মনে আত্মবিস্বাসের অভাব দেখা দেয়  এবং তারা মনে করে শারীরিক পরীক্ষার অভাবে সেবা অসম্পূর্ণ হতে পারে।
৮.চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ডিজিটাল সেবার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পায় না।
৯.প্রবীণ কর্মীরা বদলাতে অস্বীকার করে এবং নতুন প্রযুক্তি নিয়ে অনীহা প্রকাশ করে।

টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবায় চ্যালেন্জ মোকাবেলায় করণীয়

১.দ্রুত গতির ৫G ও ব্রডব্যান্ড সম্প্রসারণ পরিবর্তন আনতে হবে।
২.স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ডিজিটাল ট্রেনিং সেশন আয়োজন, UX/UI সহজ করে উৎসাহিত করতে হবে।
৩.সরকারের হেল্পলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আধুনিক ও GDPR/HIPAA সমমানের পর্যায় উন্নত করতে হবে।
৪.জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোকে ডাটা এনক্রিপশন, আবেদন-বিজ্ঞপ্তি ও নিয়ম-নীতি নিশ্চিত করতে হবে। ৫.AI‑ভিত্তিক চ্যাটবট যোগ করে ইমিডিয়েট উত্তর ও রোগীর ডাটা বিশ্লেষণ সহজ হবে।
৬.IoT‑ভিত্তিক পরিধানযোগ্য ডিভাইসের মাধ্যমে রিয়েল‑টাইম মনিটরিং বাড়তে পারে।
৭.দরকারি ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল + ইন-পার্সন কনসাল্টেশনএর মত হাইব্রিড  সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে রোগীর আস্থা শক্তিশালী হয়।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে টেলিমেডিসিনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল, বিশেষ করে দেশের গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার নাগাল এখনও সীমিত। বর্তমান ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের যুগে বাংলাদেশের প্রায় ১২৫ মিলিয়ন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মাধ্যমে তরুণ ও প্রবীণ উভয় শ্রেণির মানুষের কাছে টেলিমেডিসিন সহজে পৌঁছে যাচ্ছে । এই প্রবণতা করোনা মহামারীর সময় বিশেষভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল, যখন হাসপাতালগুলোতে সরাসরি যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ার কারণে ভিডিও কনসালটেশন, কনফারেন্স এবং হেল্পলাইনের মাধ্যমে সেবা চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

সরকারের ডিজিটাল হেল্পলাইন ১৬২৬৩এবং ৩৩৩রাজধানীসহ বেড়িয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বিনামূল্যে পরামর্শ ও এম্বুলেন্স কল সার্ভিস চালু করেছে।বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বরাতে জানা যায় ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ এককভাবে ৩ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের সেবা দিয়েছে, যা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগ যেমন Doctor Koi, Maya, Praava, CMED এবং DocTime, MediTor প্রভৃতি প্ল্যাটফর্ম চালু হওয়ায় telemedicineএর গতি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গ্রামীণ চিকিৎসা সমস্যা যেমন ডাক্তার-হাসপাতাল ঘাটতি, দীর্ঘ পথ এবং সংশ্লিষ্ট খরচ টেলিমেডিসিন সহজেই দূর করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিরীক্ষণ, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ সকল ক্ষেত্রেই রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যবর্তী দূরত্ব দূর করে  দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে । এছাড়া, মহিলাদের গোপন ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শে টেলিমেডিসিন নীরব প্রতিবন্ধকতা দূর করে এবং সুশৃঙ্খল সেবা দিতে সক্ষম ।

তবে এটি চ্যালেঞ্জবিহীন নয়। গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোর দুর্বলতা, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, ডেটা সুরক্ষার কাঠামো না থাকা, এবং সুনির্দিষ্ট আইনবিধির অভাব টেলিমেডিসিনের প্রসারকে ব্যাহত করছে । তাছাড়া, ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিশ্বাস এবং চিকিৎসা সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কতটা বজায় থাকবে, তার বিষয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে । তাই যথাযথ প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

ভবিষ্যতে, এআই, আইওটি, রিমোট মনিটরিং ও ডিজিটাল হেলথ রেকর্ডের মতো উন্নত প্রযুক্তিগুলোকে ব্যবহারে telemedicine এর সম্ভাবনা আরও বাড়বে । যেমন মোবাইল হেলথ অ্যাপ, AI-চালিত রোড নিয়ন্ত্রণ, স্মার্ট ECG মনিটরিং, এবং রিমোট ভিডিও ও ডেটা শেয়ারিং পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ে বৈপ্লবিক উন্নতি আসতে পারে । এছাড়া স্যাটেলাইট-ভিত্তিক উদ্যোগ যেমন Satmed এর মাধ্যমে চরাঞ্চলে হাসপাতাল জাহাজে রিমোট কনসালটেশন বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা ঘাটতি পূরণে সক্ষম।

সারসংক্ষেপে, বাংলাদেশের telemedicine  শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম নয় বরং এটি স্বাস্থ্যখাতে ন্যায্যতা, গুণগত মান এবং প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যত গঠনে অন্যতম মাধ্যম। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা নির্দিষ্টকরণ, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে Telemedicine বাংলাদেশে একটি স্থায়ী ও ব্যাপক স্বাস্থ্য বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে।

শেষ কথা


বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন একটি যুগান্তকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম হিসেবে গৌরবময় প্রমাণ করছে, যা সাধারণ মানুষের নাগাল বাড়িয়ে দিচ্ছে ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া, সময় ও খরচ বাঁচানোসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে । বিশেষ করে, ভিডিও-কনসালটেশনের মাধ্যমে মানসম্মত সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩’ ও ‘৩৩৩’ হেল্পলাইনের মাধ্যমে।

তবে, চালুদের পথে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ: গ্রামীণ‌ অঞ্চলে ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংকট, নিচু ডিজিটাল সাক্ষরতা, ডেটা সুরক্ষা আইনের ঘাটতি এবং ভার্চুয়াল কনসালটেশনের প্রতি মানুষের আস্থা । এই বাধা অতিক্রম করতে প্রয়োজন দক্ষ প্রশিক্ষণ, শক্তিশালী আইনি কাঠামো ও অবকাঠামো বিনিয়োগ।

সঠিক দিকনির্দেশনা ও অংশীদারিত্বে, বিশেষ করে এআই, আইওটি ও রিমোট মনিটরিং প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে, টেলিমেডিসিন দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে স্বাস্থ্য বিপ্লবের ভিত্তিমূল্য হতে পারে। সুষ্টু বাস্তবায়ন হলে এটি বাংলাদেশে সমতাভিত্তিক, নির্ভরযোগ্য ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url